‘রোগের সংক্রমণ নেই’ হাদিসটির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা
শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.
সহিহ বুখারিতে এসেছে, আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ স. বলেন:
«لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ، وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ، وَفِرَّ مِنَ المَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الأَسَدِ»
‘রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, পাখির মধ্যে কুলক্ষণ নেই, পেঁচায় কোনো অশুভ লক্ষণ নেই এবং সফর মাসেও কোনো অশুভ নেই। আর সংক্রামক রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ (সহিহুল বুখারি: ৫৭০৭)
আব্দুল ফাত্তাহ বলেন: আমার মতে (لاَ عَدْوَى) এর অর্থ হলো—(لَا يُعْدِ بَعْضُكُمْ بَعْضًا ) ‘তোমরা একে অপরকে সংক্রমিত করো না।’ অর্থাৎ, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী যেন সুস্থদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে বিরত থাকে, যাতে আল্লাহর তাকদির অনুসারে সে অন্যদেরও সংক্রমিত করার আশঙ্কা তৈরি না হয়। এখানে (لا) শব্দটি نهي বা নিষেধসূচক অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনটি কুরআন মাজিদেও এসেছে:
فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ
‘এই সময়ে যদি কেউ হজের নিয়ত করে তবে হজের সময় সহবাস নেই, গুনাহের কাজ নেই এবং ঝগড়া-বিবাদও নেই।’ (সুরা বাকারা, ২:১৯৭)
এখানে (فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ) ‘সহবাস নেই, গুনাহের কাজ নেই এবং ঝগড়া-বিবাদও নেই’ এর অর্থ হলো, (فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَفْسُقْ وَلَا يُجَادِلْ فِيْ أَثْنَاءِ قَيَامِهِ بِالْحَجِّ) ‘সে যেন হজ্জের সময় সহবাস, গুনাহের কাজ এবং ঝগড়া-ফাসাদ থেকে বিরত থাকে।’
অনুরূপভাবে, (لاَ طِيَرَةَ) এর (لا) শব্দটি نهي বা নিষেধসূচক অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং (لاَ طِيَرَةَ) ‘পাখির মধ্যে কুলক্ষণ নেই’ এর অর্থ হবে—(لَا تَتَطَيَّرُوْا وَلَا تَتَشَاءَمُوْا بِالطَّيْرِ) ‘তোমরা পাখি থেকে অশুভ লক্ষণ নিয়ো না।’ জাহিলি যুগে আরবরা পাখি দেখে শুভ-অশুভ নির্ণয় করত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হওয়ার সময় তারা একটি পাখি ছেড়ে দিত। পাখিটি ডান দিকে গেলে তারা মনে করত কাজটি শুভ হবে। তাই তারা কাজটি করতে বেরিয়ে পড়ত। আর বাম দিকে গেলে মনে করত কাজটি অশুভ হবে। তাই তারা কাজটি থেকে বিরত থাকত।
একইভাবে, (لاَ هَامَةَ) ‘পেঁচায় অশুভ নেই’ এর অর্থ হলো, (وَلَا تَتَشَاءَمُوْا بِالْهَامَةِ) ‘তোমরা পেঁচাকে অশুভ মনে করো না।’ জাহেলি যুগে আরবরা বিশ্বাস করত, নিহত ব্যক্তির খুনের প্রতিশোধ গ্রহণ করা না হলে তার আত্মা পেঁচা হয়ে ফিরে আসে। আর প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত সে বলতে থাকে আমি পিপাসার্ত আমাকে পান করাও। ইসলাম এই ভ্রান্ত আকিদা পোষণ করতে নিষেধ করে।
এমনিভাবে, (لاَ صَفَرَ) ‘সফর মাসে অশুভ নেই’ এর অর্থ হলো—(وَلَا تَتَشَاءَمُوْا بِشَهْرِ صَفَر) ‘তোমরা সফর মাসকে অশুভ মনে করো না।’ জাহেলি যুগে আরবরা সফর মাসকে অশুভ মনে করত। কেননা তাদের কাছে এই মাস খুবই কঠিন সময় ছিল। তারা জুল কা’দাহ, জুল হিজ্জা, মুহাররম, রজব—এই চারটি মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, খুন-লুণ্ঠন ও প্রতিশোধ গ্রহণ অবৈধ মনে করত। তাই এই চারটি মাস (الأشهر الحرم) বা পবিত্র মাস নামে অভিহিত হতো। প্রথানুযায়ী যুদ্ধবিগ্রহমুক্ত জুল কা’দাহ, জুল হিজ্জা, মুহাররম—এই তিন মাস অতিক্রান্ত হতেই যখন সফর মাস শুরু হতো তখন ব্যাপক হারে যুদ্ধবিগ্রহ, খুন-লুণ্ঠন ও প্রতিশোধ গ্রহণের পালা আরম্ভ হয়ে যেতো। এসব কারণে তারা এই মাসকে অশুভ মনে করত। ইসলাম এমন ভ্রান্ত আকিদা পোষণ করতে নিষেধ করে। প্রকৃতপক্ষে কোন সময়ই মানুষের জন্য অশুভ বা ক্ষতিকর নয়। বরং যে সময় মানুষ যে মন্দ কাজ করে তা-ই ওই সময়ে অশুভ এবং ক্ষতি বয়ে আনে। সুতরাং মানুষের কর্মের প্রতিফলই সময়কে অমঙ্গলজনক করে তোলে—এমন নয় যে, কোন সময়ের মাঝে অমঙ্গল রয়েছে।
উক্ত হাদিসের শেষ অংশে রাসুলুল্লাহ স. বলেন, (وَفِرَّ مِنَ المَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الأَسَدِ) ‘আর সংক্রামক রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ এই কথাটুকু সেই একই হাদিসেরই অংশ। অনেক আলেম এই অংশকে ভিন্ন হাদিস মনে করেছেন—যা সঠিক নয়। সুতরাং হাদিসটির প্রথম অংশ (لاَ عَدْوَى) শেষ অংশ (وَفِرَّ مِنَ المَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الأَسَدِ) এর সাথে মর্মের দিক থেকে পরিপূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। রাসুলে কারিম স. সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীকে মানুষের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন। যাতে সে আল্লাহর তাকদির অনুসারে সংক্রমণ ঘটিয়ে মানুষকে কষ্ট না দেয়। অনুরূপভাবে তিনি সুস্থ ব্যক্তিকে রোগ সংক্রমণের মাধ্যমসমূহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
উল্লিখিত অর্থটি সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে (হাদিস নং: ২২২১) বর্ণিত হাদিসটির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। হাদিসটি সহিহ বুখারিতে এসেছে এই শব্দে—
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : «لاَ يُورِدَنَّ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ»
‘হজরত আবু হুরাইরা র. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: তোমরা অসুস্থ উটগুলোকে সুস্থ উটগুলোর কাছে নিয়ে যেয়ো না।’ (সহিহুল বুখারি: ৫৭৭১)
এখানে রাসুল স. উটের মালিককে নিষেধ করছেন অসুস্থ উটগুলোকে সুস্থ উটগুলোর কাছে নিয়ে যেতে। আর তা কেবল আল্লাহর তাকদির অনুসারে সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বলেছেন।
ইসলাম কেবল বাহ্যিক সংক্রমণকে স্বীকার করে তা নয় বরং আত্মিক ও চারিত্রিক প্রভাবকেও সমর্থন করে। আবু হুরাইরা র. থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন:
«الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ»
‘মানুষ তার বন্ধুর মতাদর্শ লালন করে, সুতরাং (কারও মতাদর্শ সম্পর্কে জানতে চাইলে) তোমরা লক্ষ কর, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে।’ (সুনানু আবি দাউদ: ৪৮৩৩; সুনানুত তিরমিজি: ২৩৭৮)
অপর হাদিসে এসেছে, আবু সাইদ খুদরি র. থেকে বর্ণিত রাসুল স. ইরশাদ করেন:
«لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا، وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِيٌّ»
‘মুমিন ব্যতীত কারও সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো না এবং মুত্তাকি ছাড়া তোমার খাবার যেন কেউ না খায়।’ (সুনানু আবি দাউদ: ৪৮৩২; সুনানুত তিরমিজি: ২৩৯৫; মুসনাদু আহমাদ: ১১,৩৩৭; সহিহু ইবনি হিব্বান: ৫৫৪)
অপর হাদিসে রাসুল স. বলেন:
«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»
‘প্রত্যেক শিশু ইসলামি ফিতরত ও স্বভাব-প্রকৃতির নিয়ে জন্মগ্রহণ করে অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদি, খ্রিস্টান এবং অগ্নিপূজক বানায়।’ (সহিহুল বুখারি: ১৩৮৫)
অর্থাৎ পিতামাতা তাদের সাহচর্য, মেলামেশা ও সংস্পর্শের মাধ্যমে তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়।
মূল: আল-মাসনু ফি মারিফাতিল হাদিসিল মাওদু কিতাবের শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. কৃত হাশিয়া: ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠা।
Comment